অনুদান পেতে ঝালকাঠিতে লাখো শিক্ষার্থীর আবেদন

রহিম রেজা, ঝালকাঠি থেকে
দক্ষিণ বাংলা মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১
অনুদান পেতে ঝালকাঠিতে লাখো শিক্ষার্থীর আবেদন

ঝালকাঠি শহরের চাঁদকাঠি এলাকায় ছয় শতাংশ জমির ওপর তিনতলা ভবন রয়েছে। করছেন সরকারি চাকরি। ছেলে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সরকারি অনুদান নিতে ওই শিক্ষার্থী অনলাইনে আবেদন করেছেন। আবেদনের যৌক্তিকতার স্থানে এ শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘শিক্ষাগ্রহণে জন্য অনুদানের টাকা খুবই প্রয়োজন’। উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়েন রনি তালুকদার (ছদ্দনাম)। তাঁর বাবার শহরের টিনপট্টি এলাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর্থিক অবস্থাও ভালো। এ শিক্ষার্থীও সরকারের অনুদান পেতে অনলাইনে আবেদন করেছেন। বাবার পেশা ‘ব্যবসায়ী’ না লিখে সে ‘কৃষক’ লিখে আবেদন করে। নলছিটি শহরের হাসপাতাল সড়কের বাসিন্দা কামাল হোসেন (ছদ্দনাম)। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তাঁর ছেলে পড়েন সরকারি নলছিটি মার্চেন্টস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে।

পারিবারিক অবস্থায় তাদের ভলো। তাঁর ছেলেও অনুদান পেতে আবেদন করেছেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ঝালকাঠি জেলায় লাখো শিক্ষার্থী সরকারি অনুদান পেতে অনলাইনে আবেদন করেছেন। ষষ্ঠ থেকে অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সরকারের ‘একসেবা ডট কম’ এ প্রবেশ করে ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অসহায়, দরিদ্র মেধাবী, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অনুদান প্রদানের ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব শ্রেণির মধ্যে যারা পড়েনি, বেশিরভাগই আবেদন তাদের। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অভিযোগ করেছেন, কম্পিউটারের দোকানীরা শিক্ষার্থীদের আদেবন ফরম পূরণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সরকার প্রতিবছরই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনুদান দেন তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু এ বছর স্বচ্ছল ব্যক্তিদের সন্তানরাও অনুদান পেতে আবেদন কেরেছেন, যা আগে কোন বছর হয়নি। আবেদনের জন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যয়নও সংগ্রহ করতে হয়েছে। ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে উদ্বুব্ধ করা হয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরে ঝালকাঠি সদর, নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলার কম্পিউটারের দোকানগুলোতে ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের উপচে পড়া ভীড়। ফরম পূরণ করা নিয়ে দোকানীরাও ছিলেন ব্যস্ত। সরকারি অনুদানের ফরম পূরণ করতে কম্পিউটারের দোকানগুলোতে হিড়িক পড়েছে। ১৫ মার্চ ফরম পূরণের শেষ দিনেও রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা ছিল দোকান। এতটাই ভীড় ছিল, যে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করতে না পেরে ফিরেও গেছে। আবেদন ফরম পূরণ করা কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার টাকা দিবে, নিতে অসুবিধা কোথায়।

সবাই আবেদন করতে পারবে, তাই তাঁরাও আবেদন করেছেন। ভাগ্যে থাকলে পেতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অনুদানের টাকা। ঝালকাঠি জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে শিক্ষার্থীদের বিশেষ অনুদানের জন্য শিক্ষা বিভাগ ঘোষণা দিয়েছে। এতে কয়েকটি ক্যাটাগরি রয়েছে। যেমন শিক্ষার্থীকে গরিব, অসহায়, মেধাবী ও প্রতিবন্ধী হতে হবে। কিন্তু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের সন্তানরাও এতে আবেদন করেছেন। তাই সরকারের এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ঝালকাঠি শহরের রোনালসে সড়কের কাজী কম্পিউটারে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী অনুদানের জন্য ফরম পূরণ করেছে।

এছাড়াও দোয়েল, তারুণ্য বিডি, ক্লাসিক আইটি, ইসলামিয়া ও চন্দ্রবিন্দুসহ শহরের অর্ধশত কম্পিউটারের দোকানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ ফরম পূরণ করে। এছাড়াও অনেকে বাড়িতে বসে ব্যক্তিগত কম্পিউটারেও আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন। জেলা সদরের বাইরে নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলাতেও একই অবস্থা। কম্পিউটারের দোকানের পরিচালকরা জানিয়েছেন, জেলায় প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী অনুদান পেতে আবেদন করেছেন। এখানে কোন ক্যাটাগরি হিসেব না করেই গণহাড়ে শিক্ষার্থীরা আবেদন করেন। তারুণ্য বিডি’র পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শেষ সময়ে অন্য কাজ বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনুদানের ফরম পূরণ করা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। অনেককে ফেরতও দিয়েছি। যাদের আবেদন করতে বলা হয়েছে, তাঁরা ছাড়াও না বুঝে গণহাড়ে আবেদন করেছে শিক্ষার্থীরা।

আবেদন ফরম পূরণ করার জন্য কম্পিউটারের দোকানে একশ টাকা ফি নেওয়া হয়েছে। অনেকে বেশি দিয়েও দ্রুত ফরম পূরণ করিয়েছেন। আমাদের কাজ ফরম পূরণ করে দেওয়া, তাই দিয়েছি, কিন্তু অনুদান পাবে কিনা তা জানি না। নলছিটি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জলিলুর রহমান আকন্দ বলেন, প্রতি বছরই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সরকার অনুদান প্রদান করেন। জেলায় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী এ অনুদান পায়। কিন্তু এ বছর অনেকেই ক্যাটাগরি না বুঝেই গণহাড়ে আবেদন করেছেন। কম্পিউটারের দোকানীরা শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণে বেশি উদ্বুব্ধ করেছেন। আমি শুনেছি নলছিটি থেকে ২৫-৩০ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন।

এ ব্যাপারে ঝালকাঠি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে নির্দেশনা ছিল, তা না মেনেই অনেকে আবেদন করেছেন। স্বচ্ছল ব্যক্তিদের সন্তানরা এ সুবিধা পাবেন না। তারপরেও কেন তারা আবেদন করেছেন, জানি না। ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে উদ্বুব্ধ করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত গরিব, অসহায় মেধাবী, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এ অনুদান থেকে বঞ্চিত হতে পারে।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD