সরকারের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের শহীদ বেসামরিক গেজেটভুক্ত হয়ে ভাতাপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকলেও উপজেলার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কোথাও নাম না থাকায় আবদুল গফুর নামের এক ব্যক্তি এবং অপর তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবরস্থান এলাকায় না থাকায় সরকারীভাবে কবরস্থান বাঁধাই করা নিয়ে বিপাকে পরেছেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসন।
এলাকায় এত মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের অস্তিত্ব থাকা সত্বেও গণপূর্ত অধিদপ্তর কিসের ভিত্তিতে অস্তিত্ব বিহীন কবরস্থান বাঁধাইয়ের টেন্ডার আহ্বান করেছে তা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা।
এলাকায় কেউ জানেন না তিনি মুক্তিযোদ্ধা, অথচ তার নাম রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের শহীদ গেজেটে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের শহীদ বেসামরিক গেজেট (নং-৭) এ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখের প্রকাশিত ৯৫২২ পৃষ্ঠায় আগৈলঝাড়া উপজেলার বারপাইকা গ্রামের আব্দুর রহমান শিকদারের ছেলে শহীদ আবদুল গফুর এর নাম লেখা রয়েছে। এছাড়াও ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট এর অতিরিক্ত সংখ্যায় (৯৫২২ পৃষ্ঠায়) বরিশাল বিভাগের বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলায় শহীদ আবদুল গফুরের নাম রয়েছে, যার ক্রমিক নং-৭।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষিত ১৬ জন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আবদুল গফুরের নাম নেই কোথাও। আবদুল গফুরের সন্তানেরা ঢাকা থেকে শহীদ পরিবারের সরকারী ভাতা গ্রহণ করছেন বলে একটি বিস্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
বরিশাল জেলা, আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত বরিশাল জেলার সদর উপজেলা ও আগৈলঝাড়া উপজেলাসহ ১০টি উপজেলায় সরকারী গেজেট অনুযায়ী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (১ম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রতি কবরস্থানের জন্য ২লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান নির্মাণ করার জন্য সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
গনপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এক পত্রের আলোকে বরিশাল গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বিষয়টি বরিশাল জেলা প্রশাসককে অবহিত করে ২৫.০৬.০০৬০.১১নং স্মারকে এক পত্রে জেলার ১০ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান শনাক্ত করে বুঝিয়ে দিয়ে ইউএনওদের মাধ্যমে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানিয়ে একটি তালিকা প্রেরণ করেন।
আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আবুল হাশেম তালিকা পেয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালাকে গত ৯মে যাচাই-বাছাই পূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রাপ্ত তালিকানুযায়ী আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের মধ্যশিহিপাশা গ্রামের মৃত মুন্সি রওশন আলী মোল্লার ছেলে শহীদ আব্দুল মান্নান মোল্লা, বাকাল ইউনিয়নের পয়সারহাট গ্রামের মৃত খাদেম আলী মোল্লার ছেলে শহীদ সামচুল হক মোল্লা, একই গ্রামের মৃত ইউসুফ আলী বখতিয়ারের ছেলে শহীদ তৈয়ব আলী বখতিয়ার ও রত্নপুর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামের আব্দুর রহমান শিকদারের ছেলে শহীদ আবদুল গফুর এর বাড়ি সরেজমিনে পরিদর্শণ করেন।
সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা জানান, তার পরিদর্শনকালে তালিকাভুক্ত শহীদ আব্দুল মান্নান মোল্লা, শহীদ সামচুল হক মোল্লা, শহীদ তৈয়ব আলী বখতিয়ারের কবরস্থান তাদের বাড়িতে দেখতে পাননি। তিনি আরও জানান, তিনজন উপজেলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা তার পরে তাদের লাশ খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনেরা। বিপত্তি ঘটে যখন সমাজসেবা কর্মকর্তা শহীদ আবদুল গফুরের কবরের অনুসন্ধানে তার নিজ বাড়ি বারপাইকা, রত্নপুর গ্রামে যান। সমাজসেবা কর্মকর্তা সেখানে যাবেন জানতে পেরে পূর্ব হতেই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ সেখানে জড়ো হন এবং শহীদ আবদুল গফুর কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন মর্মে বিক্ষোভ প্রদর্শণ করতে থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রত্নপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান জানান, শহীদ গেজেট ধারী আবদুল গফুর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান আমলে নিজ বাড়িতে বসে কলেরা রোগে মারা গেছেন, সে কি করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আসেন।
সাবেক কমান্ডার মো: ফারুক ভূইয়া জানান, স্বাধীনতা সংগ্রামের আগেই কলেরায় মারা যাওয়া ব্যক্তি যদি শহীদ গেজেটের তালিকায় আসেন সেটা আমাদের জন্য কলংকের, আমরা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ এর তীব্র বিরোধীতা করছি।
আবদুল গফুরের সহপাঠি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোঃ সোহরাব উদ্দিন জানান যে, আবদুল গফুর আমার সহপাঠি, তার ডান হাতের কব্জি ছিল না সে বা হাত দিয়ে খাবার খেত ও লিখত। তাছাড়া সে ১৯৬৮ সালে নিজ বাড়িতে বসে কলেরা রোগে মারা গেছে সে সময় আমরা বাড়িতেই ছিলাম, আমার প্রশ্ন হলো তার নাম কি করে শহীদ গেজেটে আসে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সহকারী কমান্ডার ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রত্নপুর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ লিয়াকত আলী হাওলাদার জানান আগৈলঝাড়া উপজেলায় ১৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে আমরা জানি। যাদের প্রতি বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে উপজেলা প্রশাসন হতে সম্মাননা দেয়া হয় এর বাইরে কোন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমার জানা মতে আমাদের উপজেলায় নেই।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সহকারী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক সরদার জানান, আবদুল গফুর নামে কোন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমাদের উপজেলায় আছেন বলে আমার জানা নেই।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আবুল হাশেম সাংবাদিকদের বলেন, অস্তিত্বহীন এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের কিভাবে মন্ত্রণালয় তালিকা করেছে তা তার জানা নেই। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রেরিত চার জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দেয়া হয়েছে। এখনও সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা প্রতিবেদন দাখিল করেন নি। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন যে, তালিকার তিন জন প্রকৃত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাদের লাশ না পাওয়ায় কবরস্থানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অপর একজন শহীদ আবদুল গফুর বিতর্কিত ব্যক্তি। তিনি নাকি মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা গেছেন। আমরা বিতর্কিত ব্যক্তি বা অস্তিত্বহীন কবরের বিষয়ে রিপোর্ট জমা দেবো।
উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির প্রথম সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুক্তিযোদ্ধা রত্নপুর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামে। ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীন ব্যক্তিসহ অন্তত দু’শত মুক্তিযোদ্ধার সাথে তিনি কথা বলে জানতে পেরেছেন যে, গফুর নামে কোন মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নেই। গফুর নামে এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের আগেই কলেরায় মারা গেছেন।
অস্তিত্বহীন বা বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় কিভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে জানতে চাইলে বরিশাল গনপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জেড়াল্ড অলিভার গুডা সাংবাদিকদের বলেন, এটা এক বছর আগে টেন্ডার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় থেকে দেয়া তালিকার ভিত্তিতে গনপূর্ত বিভাগ ২লাখ টাকা ব্যয়ে একেকটি কবরস্থান বা শ্মশান বাঁধাইয়ের কাজ বাস্তবায়ন করছে। জেলার অধিকাংশ জায়গায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবরস্থান নিয়ে ঝামেলা ও বির্তক থাকায় সঠিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান শনাক্ত করার জন্যই জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমান তালিকার বাইরে অন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর বাঁধাই কাজের সুযোগ আছে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন সেটা হয়তো দ্বিতীয় পর্যায়ে হতে পারে। এবিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।