ইমপালসের সাধারণ বেডে ৬ দিনের বিল ২ লাখ ৬২ হাজার!

ডেস্ক রিপোর্ট
দক্ষিণ বাংলা বুধবার, ২১ এপ্রিল, ২০২১
ইমপালসের সাধারণ বেডে ৬ দিনের বিল ২ লাখ ৬২ হাজার!

রাজধানীর গুলশান-২ এর বাসিন্দা মরিয়ম খাতুন। ১০ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হন। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। শারীরিক অবস্থা একটু খারাপ হলে গত ১৪ এপ্রিল ভর্তি হন তেজগাঁওয়ের সরকার-নির্ধারিত বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড ইমপালস হাসপাতালে। ২০ এপ্রিল সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়েন তিনি। কিন্তু যাওয়ার সময় হাসপাতালের বিল দেখে মাথায় হাত! এ ছয় দিনে তারা বিল ধরিয়ে দিয়েছে দুই লাখ ৬২ হাজার ৭২৬ টাকা। কিছুটা অবাক হয়ে মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘কেবিনে ছিলাম না। ছিলাম ছয় রোগীর একটি সাধারণ ওয়ার্ডে। তারপরও এত টাকা বিল!’

মরিয়ম খাতুনের চিকিৎসার বিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করে, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথা ল্যাব টেস্ট বাবদ ৩০ হাজার ৭২০ টাকা। মোট হাসপাতাল চার্জ এক লাখ ৪০ হাজার ৫৪০ টাকা। বিশেষ কোনো সার্ভিস না থাকলেও সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে তিন হাজার ৬৭৫ টাকা। মেডিসিন বিল ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার ২৬১ টাকা। এছাড়া ফিক্সড বিল নামে আরও একটি অজ্ঞাত বিল ধরা হয়েছে ৮২ হাজার ২৫০ টাকা। সবমিলিয়ে মোট বিল এসেছে দুই লাখ ৬২ হাজার ৭২৬ টাকা।

এমন বিল প্রসঙ্গে মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘তাদের কিছু টাকা কম রাখার অনুরোধ করেও কাজ হয়নি। ভর্তি যখন হয়েছি, কী আর করব বাবা! বিল তো দিতেই হবে। না দিলে দেখা যাবে বিলের জন্য আমাকে আটকে রেখেছে!’ শুধু মরিয়ম খাতুন নয়, এমন অনেকেই ইমপালস হাসপাতালের চিকিৎসা বিল নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন।

মীর হাসান নিয়াজ নামে এক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আসেন ইমপালস হাসপাতালে। চারদিন হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়। এর মধ্যে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) থাকতে হয় দুদিন। অবশেষে মা সুস্থ হলেও হাসপাতালের বিল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মীর হাসান নিয়াজ। বলেন, ‘দুদিনে শুধু অক্সিজেন ব্যবহার করে আইসিইউ বিল দিতে হয়েছে দুই লাখ টাকা। চিকিৎসার নামে আমাদের গলাকাটা হয়েছে এখানে। ডাকাতি বললেও ভুল হবে না।’

হাসপাতালটির সামনের এক দোকানি নাম প্রকাশ না করে জানান, তার এক আত্মীয় ১০ দিন এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিল এসেছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। নার্স, কর্তব্যরত চিকিৎসক সেভাবে কাছে না গেলেও বিলে তাদের ফি ধরা হয়েছে। রোগীর লোকজন নিজেরা কক্ষ পরিষ্কার করলেও সে বাবদ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা।

এসব প্রসঙ্গে কথা বলতে ভেতরে ঢুকতেই পথ আটকান হাসপাতালটির অপারেশন ম্যানেজার মো. জিলানী। বিল প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে হাসপাতালের ভেতরে এসব নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করেন। এমনকি কাউন্টারে বসা কর্মীদেরও এসব নিয়ে প্রতিবেদককে কোনো তথ্য দিতে নিষেধ করেন হাসপাতালটির অপারেশন ম্যানেজার।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইসিইউ নিয়ে বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে। আইসিইউ’র জন্য সাধারণ রোগীদের ঘুরতে হচ্ছে হন্যে হয়ে। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বেশি থাকায় অনেকেই বেশি টাকা দিয়ে হলেও আইসিইউ পেতে বেসরকারি হাসপাতালে আসেন। এ সুযোগে আইসিইউ’র ভাড়া সাধারণ সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রাখা হচ্ছে।

অতিরিক্ত বিল রাখার বিষয়ে ইমপালস হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) অধ্যাপক ডা. খাদিজা আক্তার ঝুমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এভাবে ভুয়া কথা বললে তো হবে না। আপনি পেপার নিয়ে আসেন যে এ জায়গায় বিলটা বেশি হয়েছে। সাংবাদিকরা এভাবে কথা বলতে পারেন না।’ এ সময় প্রতিবেদক বিলের সুনির্দিষ্ট কাগজপত্র উপস্থাপন করলে তিনি বলেন, ‘এ বিল তো বেশিকিছু নয়। দেখা গেল রোগীর এক লাখ টাকার ওষুধ লেগেছে, তাহলে আপনি কী করবেন? বিল বেশি হবে না?’

কিন্তু ওই রোগীর ওষুধবাবদ ৩৬ হাজার ২৬১ টাকার বিল ধরা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘আপনি বিলের কাগজ নিয়ে আমাদের অফিসে আসেন। সেখানে জমা দিলে আমাদের লোকজন চেক করে দেখবে। পেপার না দেখে তো কিছু বলা যাবে না।’

শুধু ইমপালস হাসপাতাল নয়, রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় গলাকাটা বিল আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া হাসপাতালগুলো নিজেদের প্রয়োজনে করোনা রোগীকে নন-করোনা আর নন-করোনা রোগীকে করোনা বানানোরও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে পরীক্ষার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়ার। এসব ঘটনা বন্ধে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে জোর দাবি জানান ভুক্তভোগীরা।

রাজধানীতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের অক্সিজেনের চাহিদাও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অযৌক্তিকভাবে উচ্চমাত্রায় চার্জ নিচ্ছে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। এমনটি হওয়ার একটিই কারণ, অক্সিজেনের জন্য কত ফি নেওয়া যাবে সেই বিষয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা না থাকা।

বেসরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন এমন একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন, রোগী নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ বেশ পুরনো। করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দেওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে তাদের পরীক্ষা বা চিকিৎসার সুযোগ দিলে এমন বাণিজ্যের উৎসব শুরু হবে। পরবর্তীতে যা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে সে কারণেই শুরুর দিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা এবং এ ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ চিকিৎসার অনুমতি দিতে দেরি করা হচ্ছিল।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা চিকিৎসার নামে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এভাবে বড় আকারের বিল আদায়ের কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারের উচিত হবে বিষয়গুলো দ্রুত অনুসন্ধান করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। এভাবে চলতে থাকলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে এখন সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি ঢাকায়। হাসপাতালগুলোতে মোট আইসিইউ বেড রয়েছে ৭৩৭টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৪৯৪টি এবং ঢাকার বাইরে ২৪৩টি বেড রয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে সরকার পরীক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে অনুমতি দেয়নি। সে কারণে তখন বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল বাণিজ্যের সুযোগ আদায়ের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নানা অজুহাতে সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক হাসপাতাল বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে সরকার বাধ্য হয়ে কিছু বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কোটি টাকার বিনিময়ে করোনার চিকিৎসা করাতে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এখন সব হাসপাতালকেই করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এরপরই হাসপাতালগুলো চিকিৎসার নামে শুরু করেছে অনৈতিক বাণিজ্য।

সূত্রঃ- ঢাকা পোস্ট


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD