চেতনায় ফাটল ধরলেও ভেঙে শেষ হয়ে যায়নি

বেলায়েত বাবলু
দক্ষিণ বাংলা সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আহবান থাকে সর্বত্র। কিন্তু যে চেতনা নিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে রাজপথে রক্ত দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারেরা তাঁদের সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আমরা কি দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হতে পেরেছি? প্রতি বছর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার দাবি উঠলেও গত প্রায় সাত দশকে তা বাস্তবায়িত হওয়ার লক্ষ্মণ দেখা যায়নি। তবে এ বছর উচ্চ আদালতের একটি রায় বাংলাতে প্রকাশ করেছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন আগামী এক বছরের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাংলাতে দেয়া হবে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার বিষয়টি যারা শতভাগ নিশ্চিত করবেন তারাও যেন চুপচাপ বসে আছেন। আজকে শহীদ দিবস অথবা জাতীয় কোন দিবস পালন সরকারি ছুটি আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একুশের প্রথম প্রহর অথবা একুশের প্রভাত ফেরীতে আগের মতো প্রান খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিতে হয় তাই ইচ্ছার বাইরে গিয়েও দিতে হয়। আওয়ামী ঘরানার অনেকে এখন শহীদ বেদী অথবা মৃত্যু ব্যক্তির কফিনে ফুল দেয়াকে ধর্ম বিরোধী কাজ বলে মনে করে।

আজকাল আমরা সবাই যেন স্বার্থগত কারণে মুখে মুকে চেতনার কথা বললেও অন্তরে দেশপ্রেম বপন করিনা। ছেলে বেলায় দেখেছি জানুয়ারি মাস থেকেই পাড়া মহল্লায় শহীদ মিনার তৈরীর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেতো। ইট, কাদা মাটি সংগ্রহ, নিজেদের হাতে বেদী তৈরি, বাসায় বাসায় গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে রং করা, মাইক এনে দেশের গান বাজানো, খিচুড়ি রান্না করে সকলকে খাওয়ানো এবং রাত জেগে ফুল চুরি করে শহীদ বেদীতে দেয়ার কাজে কিশোর,কিশোরী থেকে শুরু করে যুবক, যুবতীসহ প্রায় সকল বয়সের মানুষেরা অংশ নিতো। মোট কথা চেতনার জায়গা থেকে সর্বত্র শহীদ দিবস পালন করা হতো।

বর্তমান সময়েও শহীদ দিবস পালন করা হয় তবে তা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানকার অনেক শিশু শহীদ দিবস সম্পর্কে জানেই না। ওদেরকে দেখা যাযনা দলবদ্ধভাবে শহীদ মিনার তৈরী করতে। এখানকার পাড়া মহল্লার অলিগলিতে শহীদ মিনার তৈরী হয়না। নগরে জাতীয় দিবস উপলক্ষে সরকারি নির্দেশনা মেনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন অথবা অর্ধনমিত থাকেনা। অনেক প্রতিষ্ঠান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনা। দায় ছাড়াভাবে যারা উত্তোলন করে থাকে তাতেও পতাকার সঠিক মাপ কিংবা রংয়ের ব্যবহার ঠিক থাকেনা। আবার এও দেখা যায় সকালে প্রতিষ্ঠান খুলে পতাকা টানিয়ে রাতে বন্ধ করার সময় কেউ কেউ পতাকা নামান।

আজকাল ডিজিটাল যুগে জাতীয় দিবস অনেকটা সেলফি তোলা আর বেদীতে উঠে ছবি তুলে তা ফেইস বুকে আপলোড করার মধ্যে আটকা পড়েছে। মোট কথা আমাদের চেতনায় ফাটল ধরেছে। আমরা কেমন জানি জয়বাংলা শ্লোগান কে আওয়ামী লীগের আর জিন্দাবাদ কে বিএনপির শ্লোগানের মতো জাতীয় দিবস গুলোকেও বিভক্ত করে ফেলেছি।

লেখাটি শেষ করছি একটি আশার কথা দিয়ে। কালের বির্বতনে নগরে শহীদ দিবস পালন কমে আসলেও গ্রামে এখনো তা শেষ হয়ে যাযনি। ২০২১ সালের শহীদ দিবসের দিন বিকেলে বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সাপানিয়া গ্রামে গিয়ে মনটি সত্যিই পুলকিত হয়ে উঠেছিলো। ওই গ্রামের বাড়ীর উঠানে দেখা গেছে কলা গাছ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে শহীদ মিনার। পুরনো খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো হয়েছে বেদী। সবে মাত্র স্কুলে যেতে শুরু করা ছোট শিশু কন্যা তায়েবার ইচ্ছা কে গুরুত্ব দিয়ে মা আর খালা মিলে কলা গাছ দিয়ে মিনার তৈরী করেছে। মার্বেল পেপার কেটে মিনারের পাশটি সৌন্দর্য মন্ডিত করা হয়েছে। ছোট তায়েবা বেদীতে দোয়ার মতো ফুল সংগ্রহ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কুমড়া গাছ থেকে কুমড়া ফুল আর শিম গাছের ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে মমতায় গড়া শহীদ বেদীতে। তায়েবার এ প্রচেষ্ঠা দেখে নিজে ধন্য হয়ে মনে মনে উদ্বেলিত হয়ে বলেছি আমাদের চেতনায় ফাটল ধরলেও তা ভেঙে চুড়ে শেষ হয়ে যায়নি।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD