বরিশালের অসংখ্য সাংবাদিকের বাতিঘর আকতার ফারুক শাহিন

নিজস্ব প্রতিবেদক
দক্ষিণ বাংলা বুধবার, ২১ জুলাই, ২০২১
বরিশালের অসংখ্য সাংবাদিকের বাতিঘর আকতার ফারুক শাহিন

ছেলেবেলায় ছিলেন তুখোড় বিতার্কিক। বরিশালের হয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে ছিনিয়ে এনেছেন বহু পুরস্কার। কেবল বির্তকই নয় আবৃত্তি, বক্তৃতা আর রচনা প্রতিযোগিতায়ও একসময় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্কুল জীবন শেষে কলেজে ওঠার পড়ে জড়িয়ে পড়েন সাহিত্যচর্চায়। এরপর পর থিতু হন সাংবাদিকতায়।

১৯৮৮ থেকে ২০২১ টানা ৩৩ বছর ধরে চলছে তার খবরের পিছনে ছুটে চলা। তবে আজো সাংবাদিক বলে নিজেকে দাবি করেন না; স্বভাবসুলভ ভঙিমায় হাসতে হাসতে বলেন, ‘এখনো শিখছি ভাই, শেখা হয়নি কিছুই। আমি তো সংবাদকর্মী।’

শুধু সংবাদ প্রকাশের জেরে বিভিন্ন সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, চিফ হুইপ, হুইপ, এমপি বা সিটি মেয়র এমন ৩০/৩৫ জনের মামলার আসামি হয়েছেন তিনি। সংসদ সদস্যের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় এখনো দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়।

নিজের প্রচেষ্টায় অন্তত ৪০ জন সাংবাদিককে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সন্তুষ্টির জায়গা তার এখানেই। সাংবাদিকদের বিপদে সবার আগে এগিয়ে যান নিজেই। দক্ষিণাঞ্চলে সাহসী সাংবাদিক হিসেবে যে কয়েকজনের নাম আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় তার মধ্যে তিনি অন্যতম।

এই জনপদের সকলের চেনামুখ আকতার ফারুক শাহিন। জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বরিশাল শহরে। বেড়ে ওঠাও এখানেই। ছেলেবেলায় যুক্ত ছিলেন শিশু সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে। বিতর্ক, বক্তৃতা আর আবৃত্তিরচর্চাটা ওখান থেকেই শুরু।

এরপর শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারে টানা ১৫ বছর ছিলেন মঞ্চকর্মী। বরিশাল উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি পাস করেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। এরপরের গল্পটা একটু হাস্যকর বললেন আকতার ফারুক শাহিন।

আকতার ফারুক শাহিন বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর মনে হলো ফল আসা বা কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত বসে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কিছু একটা করতেই হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন বাসের হেলপার হবেন। এতে সারাদেশ ঘুরে দেখাও হবে আবার টাকাও রোজগার করতে পারবেন।

তখন জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন সদ্য প্রয়াত মাহমুদ গোলাম সালেক। মাহমুদ গোলাম সালেক ছিলেন আকতার ফারুক শাহিনের পিতার ঘনিষ্ট বন্ধু। সেই সূত্র ধরে তার কাছে গিয়ে শাহিন আবদার করলেন, বাসের হেলপার হিসেবে চাকরি দেওয়ার।

বাস মালিক সমিতির সভাপতি মাহমুদ গোলাম সালেক সব কথা শুনে কিছুক্ষণ হেসে শাহিনকে বলেন, তুমি চলে যাও। হেলপার হওয়ার চাকরির বিষয়ে তোমাকে পরে জানাব। তিনি অবশ্য আর আকতার ফারুক শাহিনকে কিছু জানাননি। জানিয়েছিলেন শাহিনের পিতা বজলুর রশিদকে।

ছেলে ‘এইম ইন লাইফ’ বাসের হেলপার হওয়ার খবর জানতে পেরে বাবা বজলুর রশিদ অত্যন্ত রেগে গিয়েছিলেন। শাসন করেছিলেন ছেলেকে। তাতেও দমে যাননি শাহিন। তার ইচ্ছা, কিছু তাকে করতেই হবে।

ওই সময়ে খেলাঘরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা পঙ্কজ রায় চৌধুরীর কাছে গিয়ে আবদার করে বসেন, তাকে কিছু করতে দেওয়ার জন্য। তখন পঙ্কজ রায় চৌধুরী আকতার ফারুক শাহিনকে বললেন, পত্রিকায় লেখালেখি করার জন্য।

বরিশালে হাতেগোনা ৩ থেকে ৪টি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ পেত। তেমনি একটি সাপ্তাহিক বাংলার বনে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মরহুম হোসেন শাহ। পঙ্কজ রায় চৌধুরী তাকে নিয়ে গেলেন হোসেন শাহের কাছে। বাংলার বনে পত্রিকায় যুক্ত হওয়ার পরে প্রথমে প্রবন্ধ লিখতেন। এখান থেকেই সাংবাদিকতার শুরু।

জীবনের প্রথম প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে আকতার ফারুক শাহিন বলেন, নিউজ লিখে জমা দিলে সম্পাদক হোসেন শাহ লেখা দেখে পড়ে কাগজ ছিড়ে ফেলে দিতেন। বলতেন, কিচ্ছু হয়নি। কী লিখেছ এসব? এভাবে ৩০ থেকে ৩৫টি নিউজ ছিড়ে ফেলার পরে একদিন দেখা গেল সাপ্তাহিকের একটি সংখ্যায় পেছনের পাতায় ছাপা হলো ‘ভাঙা রাস্তার শহর বরিশাল’ শিরোনামে একটি খবর।

পরীক্ষার পরে অবসর কাটাতে গিয়ে হাতেখড়ি যে সাংবাদিকতায় তা একসময়ে নেশায় পরিণত হয়। আর এখন পুরোপুরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি সাংবাদিকতায় থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৯৭ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯৮ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন।

আকতার ফারুক শাহিন বলেন, ১৯৮৮ সালের দিকে সংবাদিকতা ছিল একটি সামাজিক কর্ম। সাংবাদিকতার বিনিময়ে মাইনে দেওয়ার রেওয়াজটি মফস্বলে ছিল না। অবৈতনিক পেশায় ঝুঁকে পড়ার কারণে পরিবারে দুশ্চিন্তা বাড়ে, বড় হয়ে কীভাবে চলব আমি? তা নিয়ে।

এমনকি সাংবাদিকতা থেকে ফেরাতে মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেছেন। মারধর করেছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই টলাতে পারেনি তাকে। সাংবাদিকতায় থেকে যেন না খেয়ে থাকতে না হয়, এজন্য নিজ উদ্যোগে এলএলবি পড়েন। যদিও তাকে আইন পেশায় যেতে হয়নি, নিজের পছন্দের পেশায়ই সময় কাটাচ্ছেন তিন যুগের মতো।

বাবা বজলুর রশিদ হাওলাদার স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করতেন। মা মাহমুদা বেগম ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় আকতার ফারুক শাহিনের ছোট ভাই বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী। এক ছেলে ও এক মেয়ে শাহিনের। স্ত্রী নিজেই গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

কর্মজীবনে বরিশালের অনেকগুলো স্থানীয় দৈনিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কাজ করেছেন দৈনিক দেশ বাংলা, বাংলার বাণী, আল মুজাদ্দেদ, একুশে টেলিভিশন, দ্য ডেইলি স্টার, লাল সবুজ। এখন দায়িত্বে রয়েছেন বার্তা সংস্থা ইউএনবির। যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরো প্রধান এবং এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এক জীবনের সাংবাদিকতার ইতিহাস নিয়ে অবসরের পর লেখালেখির পরিকল্পনা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৩ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে অনেক হাউজে কাজ করেছি। অনেক উত্থান দেখেছি, পতন দেখেছি। অনেক হাউজ থেকে নিজের পরিশ্রমের পাওনা টাকাটাও পাইনি।

সাংবাদিক হয়ে ওঠার পেছনে সহযোগিতা করার বিষয়ে বলেন, যারা আমাকে অসহযোগিতা করেছেন তারাও আসলে সহযোগিতা করেছেন। কারণ যিনি অসহযোগিতা করেছেন তিনি আমার সামনে চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তখন আমাকে চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে হয়েছে। এটাও এক ধরনের সহযোগিতা।

এছাড়া যাদের কথা খুব বেশি মনে পড়ে, যারা না থাকলে এই পেশায় হয়তো দাঁড়াতে পারতাম না উল্লেখ করে বলেন, প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, শাহজাহান সরদার, শফিকুল আজিজ মুকুল ভাই, ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদক আমির খসরু, বার্তা সংস্থা এপি’র ফরিদ ভাই, যুগান্তরের বর্তমান সম্পাদক সাইফুল আলম, পীর হাবিবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম রতন।

এছাড়া ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সদ্য প্রয়াত সায়মন ড্রিং, মরহুম মিশুক মুনীর, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, ইশতিয়াক রেজা, আহম্মেদ জোবায়ের, আব্দুর রহমান, শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম, হাসনাইন খুরশেদ, জহিরুল আলম, জহুরুল ইসলাম টুকু নামগুলো ঘুরেফিরে বুকের ভেতরে বাজে। এছাড়া আরও অনেকে আছেন, যাদের সবার নাম বলতে গেলে পুরো প্রতিবেদনটা কেবল নামেই ভরে ওঠবে।

এদের সহযোগিতা ছাড়া আমি হয়তো গণমাধ্যমকর্মী হয়ে উঠতে পারতাম না। বিশেষত যে নামটি না বললেই নয়, যে মানুষটির কাছে আমি চিরঋণি তিনি অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকাপোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার। সর্ম্পকের কথা বললে তার মতো ভালো বন্ধু দেশে হাতেগোনা কয়েকজন রয়েছে।

একটি বিষয় এখন আমাকে পীড়িত করে তা হলো প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন বা অন্যান্য সংগঠনে পদ-পদবী পাওয়ার জন্য সাংবাদিক সাংবাদিককে সহযোগিতা করে। এমন একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু পেশায় এই সহযোগিতা করেন না অনেকেই। এই চর্চা গণমাধ্যমে আসলে থাকা উচিত না।

তিনি বলেন, আমি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিপক্ষে না, বরং পক্ষে। পেশার শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনের দরকার আছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার আগে তার সংবাদের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। আবার কেউ গ্রেফতার হলে তিনি যদি তার প্রকাশিত সংবাদের পক্ষে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে তাকে জামিন দিতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য ধারা বাতিল করতে হবে।

কারণ সাংবাদিকতার দীর্ঘ পথে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চিফ হুইপ শহিদুল হক জামাল, আ.স.ম ফিরোজ, চিফ হুইপ, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সদর আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার, সাবেক সাংসদ আ.খ.ম জাহাঙ্গীরের দায়ের করা একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন তিনি।

এখনো পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ একেএম আউয়ালের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামি তিনি। এসব মোকাবিলা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে; তাই আমি চাই সংবাদ প্রকাশের জের ধরে মামলা হলে অন্তত প্রমাণাদির ওপর ভিত্তি করে তাকে জামিন দেওয়া হোক।

আকতার ফারুক শাহিনকে নিয়ে প্রবীণ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন এসএম ইকবাল বলেন, আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম তখন সাংবাদিকতা ছিল সামাজিক কাজ। সাংবাদিকতার বিনিময়ে বেতন পাওয়ার যুগ ছিল না। এখন দিন বদলে গেছে, সাংবাদিকতা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত যা দেখছি আকতার ফারুক শাহিন আপাদমস্তক একজন পেশাদার সাংবাদিক। বরিশালে হাতেগোনা যে কয়জন সাংবাদিকতায় সংবাদকে মুখ্য বিবেচনা করে কাজ করেন আকতার ফারুক শাহিন তার মধ্যে অন্যতম।

সাংবাদিক ইউনিয়ন বরিশালের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত বাবলু বলেন, আমি বলব আকতার ফারুক শাহিন হচ্ছেন সাংবাদিক গড়ার কারিগর। দক্ষিণাঞ্চলের ৪০ জন স্বনামধন্য সাংবাদিক তার হাত ধরে এসেছেন। যতদিন দেখেছি তিনি নিউজ পাগল একজন মানুষ।

বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান বলেন, একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি সহকর্মীদের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন, এটাই দেখে এসেছি। সাংবাদিকদের ওপর মামলা-হামলা হলে তার অবস্থানে থেকে তিনি আমাদের উপকার করেছেন।

সূত্রঃ- ঢাকা পোস্টে


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD