বিকেএসপিতে ভর্তির প্রলোভনে খুনের মামলায় আপনের বদলে কারাগারে লিমন

ডেস্ক রিপোর্ট
দক্ষিণ বাংলা শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১
বিকেএসপিতে ভর্তির প্রলোভনে খুনের মামলায় আপনের বদলে কারাগারে লিমন

ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মামলায় ভুল তদন্তের শিকার হয়ে আসামি আবু সালেকের বদলে টাঙ্গাইলের নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমের কারাভোগ দেশের আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁক-ফোকর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তারের বদলে মিনু নামে আরেক নারীর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার ঘটনা আরও বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল এ আইনি প্রক্রিয়াকে।

এবার এমনই ধরনের জালিয়াতিতে খুনের মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়ের বদলে আবু ইউসুফ লিমন নামে এক তরুণকে জড়িয়ে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। লিমনকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) খেলার সুযোগ করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

চাঁদপুরের বাসিন্দা আবু ইউসুফ লিমনের পরিবার এবং এ সংক্রান্ত মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম সরদারের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই অভিযোগের তদন্তে সত্যতা মিলেছে। গত ২ মে আদালতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে ডিবি পুলিশ।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভুক্তভোগী মো. আবু ইউসুফ লিমনের ছোট বোন লিজা বলে, ‘ভাইয়া শুধু খেলা নিয়ে পড়ে থাকতো। এসএসসি পাস করার পরে লেখাপড়া করে না দেখে ভাইয়াকে বাবা শাসন করেন। তার অনেক পছন্দের খেলা ছিল ক্রিকেট। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ভাইয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকায় যায়।’

‘শুনেছি অক্টোবর মাস থেকে কারাগারে গেছে ভাইয়া। এর আগে তাকে সব কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় যেতে বলেছিল রবিউল ইসলাম ওরফে আপন, তার সহযোগী বাপ্পী ও অন্যান্যরা। কাগজ নিয়ে যাওয়ার পর তাকে বিকেএসপিতে ভর্তি করাবে বলে খুনের মামলায় জেলে ঢোকার প্রস্তাব দেয় আপন ও তার সহযোগীরা। এমনকি জেলে গেলে এক-দেড় মাসের মধ্যে বের করে আনা হবে বলেও জানায় ভাইয়াকে। কিন্তু ভাইয়া সব কাগজপত্র নিয়ে তাদের কাছে যাওয়ার পরে তাকে ক্রসফায়ার, আমাকে তুলে নিয়ে মেরে ফেলা এবং বাবার চাকরি খেয়ে দেয়ার হুমকি দেয় তারা। এক পর্যায়ে ভাইয়াকে খুনের মামলায় আসামি হয়ে আদালতে উঠতে বলে। ভাইয়া ওদের হুমকিতে ভয় পেয়ে এই কাজ (পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা) করেছে বলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে। তাদের সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই-তিনজন মিলে ভাইয়াকে আদালতে ওঠায়। পরে ভাইয়া কারাগার থেকে ফোন করে এই ঘটনার কথা বাড়িতে জানায়।’

লিজা বলে, ‘ঢাকায় যাওয়ার পর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হলে ভাইয়ার কয়েকজন বন্ধু তাদের ফেসবুকে তার ছবিসহ পোস্ট করে স্ট্যাটাস দেয় যে, আবু ইউসুফ লিমনের খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না। তার মা-বাবা খুব টেনশন করছেন। ওই পোস্ট দেখে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে।’

আপন নম্বর কীভাবে পেলেন, জানতে চাইলে লিজা বলে, ‘আমাদের নম্বর কীভাবে পেয়েছে জানি না। জিজ্ঞেস করলে বলতো—তোমার ভাই তো আমাদের বলেছে তোমাদের খোঁজ-খবর রাখতে। কারণ সে তো খেলা নিয়ে অনেক ব্যস্ত। তোমার মা-বাবাকে বলবে যে, তোমার ভাইকে সাভারের বিকেএসপিতে ভর্তি করে দিয়েছি। সে এখন খেলা নিয়ে ব্যস্ত, তাই ফোন করতে পারছে না। তোমার ভাই ভালো আছে। তাকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করবে না, সময় পেলেই সে বাড়িতে আসবে। আমরাও তার সঙ্গে আসবো। কিন্তু গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসেও ভাইয়া বাড়িতে না আসায় আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে তাকে (আপন) ফোন করি।’

লিজা জানায়, গত ৩১ ডিসেম্বর লিমনের আপনসহ অন্যান্যদের নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা যাননি। হঠাৎ গত ১০ জানুয়ারি লিজার কাছে লিমনের ফোন আসে। কারাবন্দি লিমন ছোট বোনকে জানান, খুনের মামলায় আসামি হয়ে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। ক্রিকেটার বানানোর প্রলোভনে এক পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার মূল আসামির বদলি জেল খাটছেন তিনি।

ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক আছে আবু ইউসুফ লিমনের

এর মধ্যে ছেলের নিখোঁজ বিষয়ে কচুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন লিমনের বাবা মো. নুরুজ্জামান। তিনিও ১০ জানুয়ারিই জানতে পারেন, তার ছেলে কাশিমপুর কারাগারে।

নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমার ছেলেটা মেট্রিক (এসএসসি) পাস করার পরে ঠিকমতো লেখাপড়া করছিল না, তাই আমি কথা বলতাম না। আমি হাসপাতালের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। গরিব মানুষের সন্তান লেখাপড়া ছাড়া কী করবে?’

তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় মেয়েটা এইচএসসি পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির অপেক্ষায়। আর ছোটটা ক্লাস নাইনে পড়ে। ছেলে লেখাপড়া করে না বলে তাই বকাঝকা করেছি। সে তার মা আর বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। পরে বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যায়। গত বছর করোনার সময় বাড়ি ছিল।’

জানা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান (৩৪)। এ ঘটনায় ওই বছরের ১০ জুলাই মামুনের ভাই বাদী হয়ে ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন। এই মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এরপর ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয় মামলাটির। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়েছে।

মামলা ও নথিপত্রের সূত্রে জানা গেছে, নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া একটি চক্রের কবলে পড়েন মামুন ইমরান খান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা।

এই মামলার ৬ নম্বর আসামি হলেন রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। তিনি পলাতক রয়েছেন। কিন্তু তার পরিবর্তে আবু ইউসুফ লিমনকে গত ২০ অক্টোবর ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করানো হয় এবং আদালত তাকে কারাগারে পাঠান।

মামলার প্রকৃত আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার আশুতিয়া গ্রামে এবং তার বাবার নাম মতিউর রহমান। অন্যদিকে ২২ বছর বয়সী লিমন চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর (উত্তরপাড়া নতুন বাড়ি) গ্রামের মো. নুরুজ্জামানের ছেলে। নুরুজ্জামান কচুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

চাঁদপুরে বাড়ি হলেও লিমন এই ফাঁদে পড়ার আগে রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের একটি মেসে ভাড়া থাকতেন। ছোটখাটো কাজ করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সিটি ক্লাবে ক্রিকেট খেলা শিখতেন। সেখান থেকে রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এক পর্যায়ে তাকে ফাঁসিয়ে দেন আপন ও তার সহযোগীরা।

নুরুজ্জামান বলেন, ‘খবর পেয়ে ছেলের সঙ্গে কারাগারে দেখা করি। তার কাছ থেকে সব জানতে পারি। রবিউল হত্যার হুমকি ও টাকার লোভ দেখিয়ে লিমনকে কোর্টে পাঠায়। হুমকি ও ভয়ভীতির মুখে লিমন আদালতে নিজেকে রবিউল হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠান।’
dokhinbangla

তিনি আরও বলেন, ‘লিমনকে এক মাসের মধ্যে জামিন করার কথা বলে কোর্টে নিয়েছিল রবিউল। এরপর আর জামিন মেলেনি তার।’

পরে জালিয়াত চক্রের ফাঁদে ফেঁসে ছেলের মুক্তির জন্য আইনজীবী শামীম সরদারের শরণাপন্ন হন নুরুজ্জামান। সব কিছু জানার পর লিমনের মুক্তির জন্য ঢাকার আদালতে আবেদন করেন ওই আইনজীবী।

এ আবেদনে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন তিনি। আদালত গত ২ মার্চ বিষয়টি তদন্ত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। বিষয়টি তদন্ত করে ডিবি পুলিশ গত ২ মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে লিমনের পরিবারের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ অবস্থায় হত্যা মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে পুলিশ। এ আবেদনের ওপর আগামী সোমবার (৩১ মে) ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আদেশের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

অ্যাডভোকেট শামীম সরদার বলেন, ‘লিমনের বাবার কাছ থেকে বিস্তারিত জানার পর নিজেই অনুসন্ধান শুরু করি। ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর লিমনের মুক্তির জন্য আদালতে আবেদন জানাই। ৩১ মে আবু ইউসুফ লিমনের মুক্তির বিষয়ে করা আবেদনের শুনানি ও আদেশ দেয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত ২০ অক্টোবর যে আইনজীবী তাকে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তাকে উপস্থিত হওয়া ও তার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, সে বিষয়েও শুনানি হবে এদিন। এখন দেখার পালা আদালত কী পদক্ষেপ নেন এবং ওই দিন কী আদেশ দেন।’

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘একজনের বদলি আরেকজনকে খুনি সাজানোর এমন ঘটনা দেশে এর আগেও ঘটেছে। প্রভাবশালী লোকদের দ্বারা এসব ঘটনা ঘটে থাকে। তবে কোনো আসামিকে আত্মসমর্পণ করানোর সময় যে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আসামি আসেন, তার উচিত এই ঘটনা যাচাই-বাছাই করে নেয়া। কারণ এই ঘটনার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা আদালতের কেউ জড়িত থাকতে পারে। এর সঠিক তদন্ত করে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।’


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD