ঝিমিয়ে পড়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

নিউজ ডেস্ক
দক্ষিণ বাংলা সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১
ঝিমিয়ে পড়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৯ যুদ্ধাপরাধীর বিচার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। এর মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ কায়সারের রিভিউ আবেদনও রয়েছে। অভিযোগ আছে, ওই রিভিউ আবেদন ও যুদ্ধাপরাধীদের আপিল দ্রুত শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের তেমন উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২৩৭ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের মামলা বিচারাধীন। জানা গেছে, বিচারক শূন্যতায় ট্রাইব্যুনালেও বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আপিল বিভাগে একটি বেঞ্চ থাকার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের আপিল ও রিভিউ আবেদনের শুনানি দ্রুত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ট্রাইব্যুনালে একজন বিচারপতিকে দ্রুত নিয়োগ দিলে বিচার প্রক্রিয়ায় যে স্থবিরতা তা কেটে যাবে।

আপিলে ঝুলছে ২৯ যুদ্ধাপরাধীর বিচার

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত ২৯ যুদ্ধাপরাধীর বিচার আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের রিভিউ আবেদনও আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পর্যায়ক্রমে আরও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে— ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মো. মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আফসার হোসেন চুটু ও মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক খান তাহের, কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমেদ, মোসলেম প্রধান, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, জামালপুরের সামসুল হক ওরফে বদর ভাই ও এস এম ইউসুফ আলী এবং যশোরের সাবেক এমপি ও জামায়াত নেতা সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন, নোয়াখালীর সুধারামের আমীর আলী ও জয়নাল আবেদীন, মৌলভীবাজারের উজের আহমেদ ও ইউনুছ আহমেদ, ফুলবাড়িয়ার রিয়াজউদ্দিন ফকিরসহ ২৯ জন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত ২৯ যুদ্ধাপরাধীর বিচার আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের রিভিউ আবেদনও আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় তিন বছর ঝুলে থাকার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানিতে গতির সঞ্চার হয়। ওই সময়ে আপিল শুনানি শেষে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এরই মধ্যে দেশে আঘাত হানে করোনাভাইরাস। বন্ধ হয়ে যায় আদালত। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি।

এদিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, বিচারপতি এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখনও যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল নিষ্পত্তিতে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইনমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ দেখছি না। আমি মনে করি, শহীদদের আত্মার শান্তির জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের আপিল দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজন।

‘আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি; মামলাজটের কারণে যদি আপিল বিভাগ যুদ্ধাপরাধীদের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করতে না পারেন, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আরও বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হোক। তিনজন বিচারপতিকে দিয়ে ট্রাইব্যুনালের ভেতরেই খণ্ডকালীন আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। সেখানে তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল নিষ্পত্তি করা সম্ভব।’ কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রসঙ্গ তুলে শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, তারা এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, আমরা তো উদ্যোগ নিতে পারব না। এখন তো আপিল বিভাগে রিভিউ শুনানি শুরু হয়েছে। আশা করছি দুই যুদ্ধাপরাধীর রিভিউ শুনানি ২১ অক্টোবর আদালত খোলার পর শুরু হবে। আপিল শুনানিতে বিচারক স্বল্পতার প্রসঙ্গ তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আগে আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চ ছিল। এ কারণে তখন আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি হতো। এখন বিচারক স্বল্পতার কারণে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। এ কারণে সময় লাগছে। পর্যায়ক্রমে যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি শুরু হবে।

ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা ৩৬, আসামি ২৩৭

করোনার কারণে গত বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রায় আসেনি। করোনা ও মৃত্যুজনিত কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। শূন্য পদে বিচারক নিয়োগ না দেওয়ায় ট্রাইব্যুনাল অকার্যকর হয়ে পড়ে।তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় বিচারক আমির হোসেন গত ২৪ আগস্ট মারা যাওয়ায় পদটি শূন্য হয়। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬টি এবং আসামি ২৩৭ জন।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার (সিনিয়র জেলা জজ) সাঈদ আহমেদ বলেন, বিচারপতি আমির হোসেন মারা যাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল আর পুনর্গঠন হয়নি। ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হলে তিন সদস্যের প্রয়োজন। বর্তমানে চেয়ারম্যানসহ দুজন বিচারক রয়েছেন। ফলে বিচার কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। নতুন বিচারপতি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল অকার্যকর থাকছে। তবে প্রশাসনিক সব কার্যক্রম চলছে।

নতুন বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, বিচারপতির পদ শূন্য হওয়ার পরই আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয় ট্রাইব্যুনালের জন্য একজন বিচারপতি চেয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেন। শুনেছি সুপ্রিম কোর্ট থেকে একজন বিচারপতির নাম প্রস্তাব করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন যেকোনো দিন মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বলেন, আমরা বিচারপতি নিয়োগের অপেক্ষায় আছি। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হলেই যুদ্ধাপরাধীদের মামলার বিচারকাজ পুরোদমে শুরু হবে। করোনার ও বিচারপতির মৃত্যুর কারণে যে ক্ষতি হয়েছে,বিচারে যে বিলম্ব হয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ করতে আমরা চেষ্টা করব। তদন্ত ও প্রসিকিউশন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৬টি মামলা বিচারাধীন। মোট আসামির সংখ্যা ২৩৭ জন। ৭৭টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন ১৬১ জন। পলাতক আছেন ১৪৪ জন। জামিনে আছেন চারজন।

গত ১১ বছরে মারা গেছেন ২২ আসামি। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের আরও ৬৯৭টি অপরাধের অভিযোগ জমা পড়েছে। যার আসামির সংখ্যা তিন হাজার ৫০৩ জন। গত ১১ বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৪২ মামলায় ১০৩ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয় ৭১ জনের। আমৃত্যু সাজা হয় ২২ জনের। অপর আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ড হয়। শিশুবয়স বিবেচনায় এক আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এখন পর্যন্ত প্রভাবশালী সাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। তারা হলেন- জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী।

জামায়াতের নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল ও রিভিউ নিষ্পত্তি হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD