অগ্রদূত বিদ্যানিকেতনের সভাপতির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ

ডেস্ক রিপোর্ট
দক্ষিণ বাংলা শনিবার, ৬ মার্চ, ২০২১
অগ্রদূত বিদ্যানিকেতনের সভাপতির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সোহরাব হোসেনের বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যকলাপ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে এক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছেন তিনি। নির্বাচন না দিয়ে গোপনে গঠন করেছেন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সাতজন শিক্ষক-কর্মচারীকে স্কুলে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু কেউ তার লাগাম টেনে ধরছে না।

সোহরাব হোসেন ২০১৫ সাল থেকে ‘ছলে বলে কৌশলে’ ওই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রয়েছেন। এর মধ্যে আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন পাঁচবার। অবৈধভাবে নিয়মিত কমিটিতে সভাপতি হয়েছিলেন একবার। যদিও এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই নিয়মিত কমিটি বাতিল করেছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এখন তিনি যে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, নির্বাচনবিহীন সেই কমিটির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের অভিযোগ, সোহরাব হোসেন কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না।বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে যখন যা মন চাচ্ছে, তা-ই করছেন। তার এমন কার্যকলাপে সবাই অতিষ্ঠ। অবিলম্বে তাকে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। অন্যথায় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়বে।

অবৈধভাবে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত

অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুল সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান এনামুল কবির। পদোন্নতি পেয়ে ২০০৯ সালে তিনি ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। এর মধ্যে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে নির্বাচন না দিয়ে গোপনে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেন সোহরাব হোসেন। তিনি ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ‘গোপন কমিটি’র বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক সোনিয়া নাহিদকে সহকারী প্রধান শিক্ষক করতে চান সোহরাব হোসেন। কিন্তু সোনিয়া নাহিদের বৈধ নিয়োগ না থাকায় ওই পদে তাকে দায়িত্ব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন প্রধান শিক্ষক এনামুল কবির। এতে ক্ষিপ্ত হন সোহরাব হোসেন।

এনামুল কবির বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন সোহরাব হোসেন। এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, ছাত্রী ও নারী অভিভাবকদের যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে তিনি আমাকে বিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করেন। অথচ আমাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়নি। একটি অভিযোগেও তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি এবং অভিযোগ প্রমাণও হয়নি। এছাড়া বরখাস্তের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাও হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ওই বিদ্যালয় থেকে চূড়ান্ত বরখাস্তের আগে তিনবার সাময়িক বরখাস্তের চিঠি দিয়েছিলেন সোহরাব হোসেন। অথচ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কোনো শিক্ষককে বরখাস্তের এখতিয়ার রাখে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বরখাস্ত চূড়ান্ত করবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আপিল অ্যান্ড আরবিট্রেশন বোর্ড।’

কোন ক্ষমতাবলে প্রধান শিক্ষক এনামুল কবিরকে বরাখাস্ত করেছেন, জানতে চাইলে সোহরাব হোসেন বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় এনামুল হককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার অপরাধের প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সোহরাব হোসেনের নানা অনিয়মের বিষয়ে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলামকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন বহিষ্কৃত প্রধান শিক্ষক এনামুল কবির।

তিনি বলেন, ‘আমি এখন মানবেতর জীবনযাপন করছি। চাকরি ফিরে পেতে আদালতে মামলা করেছি। সেই মামলা বিচারাধীন। এখন বিদ্যালয়টির বর্তমান পরিস্থিতি স্থানীয় এমপিকে জানিয়েছি। আশা করি তিনি বিদ্যালয়টির সুনাম রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।’

অবৈধভাবে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের ছয়জন শিক্ষক ও একজন আয়া এমপিওভুক্ত হন। এর দুই মাস পর ওই স্কুলে দুজন শিক্ষক, একজন গ্রন্থাগারিক, একজন অফিস সহকারী, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং একজন নিরাপত্তাকর্মী এমপিওভুক্তের তালিকায় আসেন। এর মধ্যে সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েছেন সোনিয়া নাহিদ। তিনি এই স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। অথচ সহকারী প্রধান শিক্ষক হতে গেলে স্থায়ী চাকরির ১০ বছরের অভিজ্ঞতা লাগে।

এছাড়া সহকারী শিক্ষক হয়েছেন ওলিউর রহমান। তিনিও এই স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন শিউলী আক্তার। সনদ অনুযায়ী এখন তার বয়স ৪০ বছর। অথচ এমপিও নিয়োগবিধি অনুযায়ী ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে কাউকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। সবশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে আরেকজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। তার নাম তালুকদার আব্দুল মান্নাফ।

২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটির মেয়াদ রয়েছে। ১২ সদস্যের এই কমিটির অভিভাবক সদস্যদের হিসেবে রয়েছেন আলী আকবর, আনোয়ার হোসেন ঠাকুর, রবিউল আলম ও আব্দুল আলীম। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় ওই শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন তার কিছুই জানেন না তারা। তাই গত ৫ জানুয়ারি নতুন প্রধান শিক্ষকের নিয়োগসহ বাকি ছয়জন শিক্ষক-কর্মচারীর অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঢাকা জেলা প্রশাসন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর, ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করেছেন অভিভাবক প্রতিনিধিরা। ওই আবেদনে তারা বলেছেন, ‘বিধি বহির্ভূতভাবে একক ক্ষমতাবলে ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে গোপনে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সোহরাব হোসেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিভাবক প্রতিনিধি আলী আকবর বলেন, ‘এই স্কুলে ২০১০ সাল থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়নি। নিয়োগ বোর্ডের সভাও হয়নি। এখন এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিক্ষক, অভিভাবক এবং এলাকার কেউ অবগত নন। অবিলম্বে এই অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে।’

অনিয়ম করে শিক্ষক নিয়োগ বা এমপিওভুক্তের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক শিক্ষক ও কর্মচারী যোগ্যতায় নিয়োগ পেয়েছেন এবং এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এজন্য তিনি কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের টাকা-পয়সা নেননি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নেহাল আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম বলেন, তার সংসদীয় আসনের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের বিষয়ে তেমন জানেন না তিনি। তিনি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD