গৈলা স্কুল ১৩০ বছরে-অজয় দাশ গুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক
দক্ষিণ বাংলা শনিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২২
গৈলা স্কুল ১৩০ বছরে-অজয় দাশ গুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী গৈলা হাই ইংলিশ স্কুল যাত্রা শুরু ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি, কালের বিবর্তনে যা এখন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যাত্রার প্রথম দিনেই তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থী ছিলÑ সর্বমোট ১২২ জন, যাদের বড় অংশ বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছিল। পরের বছর থেকেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গৈলা স্কুলের ১২ জন শিক্ষার্থীকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেয়। ৫০ বছর পূর্ণ না হতেই এই স্কুল থেকে এক হাজার পাঁচজন ছাত্রছাত্রী এন্ট্রান্স ও মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।

গৈলা সে সময় ‘৩৬০ ঘর জমিদার-তালুকদারের’ জন্য পরিচিত ছিল। তাদেরই একটি অংশ দাশের বাড়ির চারটি হিস্যার মালিকরা নামমাত্র পাট্টায় স্কুলকে কয়েক একর জমি হস্তান্তর করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ঘর স্থাপনের আগে এই দাশের বাড়িতেই (বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্তের বাড়ি) নেওয়া হতো ক্লাস। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময়েই গৈলা ও আশপাশের এলাকার ঘরে ঘরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। এ গ্রামেই পাঁচ শ’ বছরের বেশি আগে মনসা মঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন কবি বিজয় গুপ্ত, যেখানে গড়ে ওঠা মন্দির ও নাটমন্দির এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

এ বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরুর আগেই গৈলার কবীন্দ্র বাড়িতে (খ্যাতিমান সাহিত্যক মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি) চালু ছিল সংস্কৃত কলেজ, যেখানে এম এ-এর সমপর্যায়ের ডিগ্রি দেওয়া হতো। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত গৈলা থেকে ১৪ জন শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন কৈলাশ চন্দ্র সেন, যিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর উচ্চ পদে সরকারি চাকরির সুযোগ পরিত্যাগ করে শিক্ষকতা পেশার সম্মানকে বড় করে দেখেছিলেন। গৈলা স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা কেবল মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তুষ্ট থাকেনি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থী এমএ-এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ওই সময়কালে ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন ৫ জন, ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন ৪০ জন, মেডিকেল স্নাতক ছিলেন ৩৩ জন, প্রকৌশলী ৪৩ জন।
গৈলা স্কুল ১৩০ বছরে-অজয় দাশ গুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
এ সময়ে ডক্টরেট সহ সমমানের ডিগ্রি বাদে এম এ-এমএসসি পাস নারী ছিলেন ৪৭ জন, সাধারণ গস্খাজুয়েট ছিলেন ২৪ জন। এ সময়ে গ্রামে নারী শিক্ষার জন্য পৃথক প্রাথমিক বিদ্যালয়ও চালু হয়েছিল। গৈলা স্কুল চালুর আগে ছাত্রছাত্রীরা ৪০ কিলোমিটার দূরের বরিশাল শহরে কিংবা তিন-চার দিনের পথ নৌকা ও ট্রেনে পাড়ি দিয়ে কলিকাতা শহর অথবা ৮-১০ দিন নৌকায় প্রমত্ত পদ্ম-মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পড়তে যেতেন। একটি গ্রামে শিক্ষার প্রতি এমন আগ্রহ ভারতবর্ষের আর কোথাও দেখা যায় নাই।

সমৃদ্ধ জনপদ গৈলা। এখানে রয়েছে দু’শ বছরের বেশি পুরাতন বাজার, আধুনিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাব পোস্ট অফিস (কলিকাতা ও ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহর থেকে চাকরিজীবীরা নিয়মিত অর্থ প্রেরণের কারণে যা মানি-অর্ডার পোস্ট অফিস নামে সুপরিচিত ছিল), এবং কামার-কুমার-পরিচ্ছনতাকর্মী সহ বহুবিধ পেশাজীবীর বসবাস।বিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালে অধ্যয়নরত ও সাবেক ছাত্র মিলিয়ে অন্তত ১০০ জন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় বিদ্যালয়টি ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। এ বিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক হিসাবে কিংবা অন্যভাবে সংশ্লিষ্ট পাঁচ জনÑ আবদুর রব সেরনিয়াবাত, সুনীল কুমার গুপ্ত, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এ মালেক বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী-সমপর্যায়ের পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ বিদ্যালয়েই আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ১৯৬৮ সালে নির্মিত হয় ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিতে শহীদ মিনার। একাত্তরে তিন সন্তান ও জ্যেষ্ঠ জামাতাকে সশস্র মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে যিনি সবার কাছে মুক্তিযোদ্ধার জননী হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে, সেই রেণুকা দাশগুপ্তা এই শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন। এ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে নিজেদের অর্থে নির্মাণ করে শতবর্ষ ভবন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে ‘সৈয়দ আবুল হোসেন বৃত্তি’Ñ প্রতিটি শ্রেণির সেরা শিক্ষার্থীরা যেখান থেকে প্রতি বছর বৃত্তি পায়।

খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গৈলা স্কুলের রয়েছে অনন্য রেকর্ড। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ফুটবল-ক্রিকেট খেলায় গৈলা স্কুল সামনের সারিতে। ফুটবলে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন। নাটক-নাচ-গান-সমাজসেবার কাজেও গৈলা স্কুল অগ্রণী। বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে বিপন্নদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি একদল সাবেক ছাত্রছাত্রী নিজেরা চাঁদা দিয়ে বিদ্যালয়ের ক্যান্সার আক্রান্ত এক কর্মীকে প্রায় এক লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে। করোনাকালে ডিজিটাল সুবিধা কাজে লাগিয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ক্ষেত্রেও এ প্রতিষ্ঠান বরিশাল অঞ্চলে অগ্রণী। বিদ্যালয়ের এক ছাত্র শুভ কর্মকার রোবট তৈরি করে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছে।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়টি পরিচালিত হলেও এলাকার প্রতিটি মানুষ তাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট। উপজেলার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় আসীন গৈলা স্কুল থেকে প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয় দু’শয়ের বেশি ছাত্রছাত্রী। প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞানচর্চায় বরাবরের মতো অগ্রণী ভূমিকা নেবে, শিক্ষা বহির্ভূত কাজে অবদান রাখবেÑ সর্বোপরি প্রিয় মাতৃভূমির উন্নতি ও কল্যাণে আজীবন নিয়োজিত থাকবে, ১৩০ বছরের যাত্রা লগ্নে এটাই কাম্য।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD