টিআই আশিসের টোকেনে নগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেড় হাজার অবৈধ অটোরিকশা

ডেস্ক রিপোর্ট
দক্ষিণ বাংলা বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১
টিআই আশিসের টোকেনে নগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেড় হাজার অবৈধ অটোরিকশা

মঙ্গলবার (৯ মার্চ) সকাল ৯টা ৫ মিনিট। চট্টগ্রাম নগরের কাপ্তাই রাস্তারমাথা পুলিশ চেকপোস্টে এসে দাঁড়ায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা (চট্টগ্রাম-থ-১১-৪৩৩১)। গাড়ি থেকে নেমেই চালক আলম ট্রাফিক পুলিশের সদস্য প্রেয়স ও আজিজুরের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠেন।

২৫ মিনিট পর দৃশ্যপটে হাজির সার্জেন্ট মাকসুদ। তাকে দেখেই ট্রাফিক সদস্য প্রেয়স ও আজিজুরের তৎপরতা বেড়ে গেল। ১০ মিনিটের ব্যবধানেই চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পাঁচটি সিএনজি অটোরিকশা আটক করলেন এই দুজন। এ সময় ওই চালকদের কয়েকজনকে জরিমানা করেন সার্জেন্ট মাকসুদ। যদিও পাশে বসে তখনো খোশগল্প করেই যাচ্ছিলেন অবৈধ অটোরিকশাচালক আলম।

শুধু এই এক আলমই নন। চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সিএনজি অটোরিকশার প্রায় দেড় হাজার চালক নগর ট্রাফিক পুলিশের এমন আতিথেয়তা পেয়ে থাকেন, যারা বিশেষ একটি টোকেনের মালিক বনে গেছেন নির্দিষ্ট মাসোহারার বিনিময়ে। চট্টগ্রাম নগরে চলাচল নিষিদ্ধ এসব অবৈধ অটোরিকশা বৈধতার টোকেন দেন চান্দগাঁও থানা এলাকার দায়িত্বে থাকা শহর ও যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিস কুমার পাল।

মঙ্গলবার সকালে ঘণ্টাব্যাপী ওই পুলিশ চেকপোস্টে অবস্থান করে দেখা গেছে, কাপ্তাই রাস্তারমাথা ও কালুরঘাট এলাকা থেকে আগত সিএনজি অটোরিকশা (চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত), ট্রাক ও মোটরচালিত রিকশা থামিয়ে নির্দিষ্ট টোকেন যাচাই করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্য প্রেয়স ও আজিজুর। যেসব চালকের কাছে সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো দিক বা সাদা কাগজে টিআই আশিস, নির্দিষ্ট একটি ফোন নম্বর ও স্থানীয় দালালের নাম লেখা টোকেন আছে, তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। যাদের টোকেন নেই তাদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে মামলা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু এই একটি স্পটেই নয়। টিআই আশিস কুমার পালের এ রাজত্ব চলে নগরের চান্দগাঁও এলাকার আটটি রুটে। সেগুলো হলো- বহদ্দারহাট হক মার্কেট পয়েন্ট থেকে হাজীপাড়া, বহদ্দারহাট হক মার্কেট পয়েন্ট থেকে চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল, বহদ্দারহাট থেকে মৌলভী পুকুর পাড়-বাহির সিগন্যাল, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে ১৪ নম্বর গ্যারেজ-পাঠাইন্নাগোদা, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে হামিদচর-বিসিক শিল্প এলাকা, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে দেশ গার্মেন্টস, খাঁজা রোডের মুখ থেকে রাহাত্তারপুল, খাঁজা রোডের মুখ থেকে বলিরহাট।

আটটি রুটে টোকেনের বিনিময়ে চাঁদা আদায়ের জন্য রয়েছেন চারজন দালাল। এরাই টিআই আশিসের প্রতিনিধি হিসেবে বিশাল এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে টোকেনের বিনিময়ে চাঁদা তোলেন জয়নাল, খাঁজা রোড থেকে কাদের, সিঅ্যান্ডবি-বিসিক শিল্প এলাকা ও বহদ্দারহাট থেকে জাহাঙ্গীর ও বিপ্লব। এক্ষেত্রে তারা যোগাযোগের জন্য যেসব বিশেষ মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন সেসব তথ্যও কাছে আছে।

চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত একটি অটোরিকশা মহানগরে চালানোর জন্য এসব দালালকে দিতে হয় ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাবে শুধু অবৈধ অটোরিকশা খাতেই টিআই আশিস কুমার পালের মাসিক আয় কমপক্ষে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। এর বাইরে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে বোয়ালখালী রুটে চলাচলকারী সাড়ে ৩০০ টেম্পোকে মাসিক দেড় হাজার টাকা মাসোহারা দিতে হয়। এছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা, প্রাইভেট সিএনজি, ট্রাক ও হিউম্যান হলার থেকে মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার (এ ব্লক) মূল ফটকের কাছে কয়েকটি সিএনজি অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কাছে গিয়ে দেখতেই বোঝা যায় এসব চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত অটোরিকশা মহানগরে অবৈধভাবে যাত্রী পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছে।

এসময় জানতে চাইলে অটোরিকশাচালক মামুন বলেন, ‘টিআই স্যারের টোকেনে গাড়ি চালাচ্ছি। শুধু আমি নই, আমার মতো হাজারের ওপর চালক এভাবে টাকা দিয়েই গ্রামের গাড়ি (জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত) শহরে চালাচ্ছেন। এই টোকেন থাকলে শহরের কোথাও সমস্যায় পড়তে হয় না।’

এসময় টিআইয়ের পরিচয় জানতে চাইলে মামুন বলেন, ‘টিআই আশিস স্যার। ওনার দালালদের কাছ থেকে টোকেন নিলে শহরের ভেতর গাড়ি চালানো যায়। আমি প্রতি মাসে এক হাজার ৫০ টাকা চাঁদা দেই।’

আরেক অটোরিকশাচালক জানে আলম জানান, পলাশ নামে একজনের কাছ থেকে তিনি টোকেন নেন ১ হাজার ২০০ টাকায়। টিআইয়ের আওতায় গাড়ি চালাতে এ টাকা দিতে হয়, টোকেন থাকলে গাড়ি আর কেউ ধরে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও এলাকার যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিস কুমার পাল কাছে দাবি করেন, ‘এসব নিউজ ভুয়া। ওরা চাঁদাবাজি করে, আর টিআই ও ওসির নাম দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আপনি কাপ্তাই রাস্তার মাথায় গিয়ে একটা নিউজ করেন, দেখবেন এরপর থেকে ওই এলাকায় খালি কাক উড়বে খালি কাক। খাঁজা রোড-বহদ্দারহাট সবখানেই এ অবস্থা করা হবে। আমি নতুন আসছি তো …দেখেন এবার পরিবর্তনের ছোঁয়া পাবেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স টোকেন ও ফিটনেসবিহীন অবৈধ রুট পারমিটের বিরুদ্ধে বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালায়। তবে অভিযানের খবর আগেই পেয়ে যান অবৈধ অটোরিকশাচালকরা। যেসব সিএনজিচালক অবৈধ টোকেন নিতে বিলম্ব করেন বা নিতে অস্বীকার করেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা রেকার লাগিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করা হয়। এসবের প্রতিবাদে গত ৮ মার্চ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে মানবন্ধনের আয়োজন করে চট্টগ্রাম অটোরিকশা ও অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোটরযান আইন অনুযায়ী বিআরটিএর নিবন্ধন ছাড়া কোনো গাড়ি রাস্তায় চলাচলের সুযোগ না থাকলেও শুধু শহর ও যানবাহন পরিদর্শক-টিআইদের টোকেনে চট্টগ্রাম নগরে অনায়াসে চলছে ‘চট্টগ্রাম’, ‘প্রাইভেট’ ও ‘নিলাম’ লেখা অনিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা। এসব গাড়ি মহানগরে নিবন্ধিত গাড়ির মতো করেই সিকিউরিটি নেট (লোহার ঝাঁপ) লাগিয়ে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাত্রী বহন করছে।

এক্ষেত্রে কোনো ধরনের নম্বরপ্লেট ছাড়াই শুধু ‘নিলাম’ লেখা বোর্ড জুড়ে দিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিছু অটোরিকশা। জানা যায়, বিভিন্ন মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত সিএনজি অটোরিকশা অনেক সময় স্ক্র্যাপ হিসেবে নিলামে বিক্রি হয়। আদালত থেকে নিলামে এসব অটোরিকশা ক্রয় করে গাড়িতে ‘নিলামে ক্রয়কৃত’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে বিআরটিএ থেকে কোনো প্রকার নিবন্ধন ব্যতিরেকে নগরে এসব চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছেন ট্রাফিক কর্মকর্তাদের দালালরা।

গত সোমবার (৮ মার্চ) দুপুরে নগরের বহদ্দরহাট ফ্লাইওভারের নিচে খাঁজা রোড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কোনো দ্বিধা ছাড়াই চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত, প্রাইভেট ও নিলামে কেনা লেখা অর্ধশত সিএনজি অটোরিকশা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। এসময় কয়েকজন চালক টোকেন দিয়ে গাড়ি চালানোর বিষয়টি কাছে স্বীকার করেন। অনেকে এ প্রতিবেদকের হাতে ক্যামেরা দেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।

সেদিন বিকেলেও একই চিত্র চোখে পড়ে নগরের সিঅ্যান্ডবি এলাকায়। এ সময় কথা হয় আবুল বশর নামে এক অটোরিকশাচালকের সঙ্গে, যার গাড়িটি চট্টগ্রাম নগরের জন্য তো নিবন্ধিত নয়ই, চট্টগ্রাম জেলার জন্যও নিবন্ধিত নয়। বান্দরবান জেলায় নিবন্ধিত গাড়ির এ চালক শহরে কীভাবে গাড়ি চালান জানতে চাইলে তিনি কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়েই বলেন, ‘যেভাবে চালানো যায় সেভাবে চালাচ্ছি, এখানে টাকা দিলে সব হয়।’

আপনি কি এই গাড়ি নিয়ে শহরের সব জায়গায় যেতে পারেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল বশর বলেন, ‘হ্যাঁ… টোকেন থাকলে সব জায়গায় যাওয়া যাবে। প্রতি মাসে নতুন টোকেন নিতে হয়।’

চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরে বিশেষ টোকেনে চট্টগ্রাম জেলায় নিবন্ধিত, নিলামে ক্রয় ও প্রাইভেট অটোরিকশাগুলো অবৈধভাবে যাত্রীবহন করছে। চট্টমেট্রো নিবন্ধিত অটোরিকশার মতো লোহার নেট লাগিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এতে বৈধ গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি পুলিশের অবৈধ টোকেন বাণিজ্যের কারণে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

টিআই আশিসের এই টোকেন বাণিজ্য নিয়ে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের সঙ্গে কথা বলে। নগর পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘আপনি হিসাব নিয়ে দেখেন আমরা কী পরিমাণ সিএনজি (জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত) ধরছি। এটা বলতে পারি আমাদের অবস্থান শক্ত, আমরা এগুলোকে কোনো প্রশ্রয় দিচ্ছি না। স্পেসিক তথ্যে যদি কেউ ধরা পড়ে, তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা এখন পর্যন্ত হাতেনাতে কাউকে পাইনি।’

এসময় চান্দগাঁও থানা এলাকার দায়িত্বে থাকা শহর ও যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিস কুমার পালের নেতৃত্বে টোকেনের বিনিময়ে অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা চলার সুযোগ করে দেয়ার বেশকিছু তথ্য উপস্থাপন করে সিএমপি কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD