দেশবন্ধু সুগার মিলের ৯৪৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি

ডেস্ক রিপোর্ট
দক্ষিণ বাংলা বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১
দেশবন্ধু সুগার মিলের ৯৪৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি

লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করায় বন্ড গুদাম থেকে অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করে ৯৪৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড। ভ্যাট ফাঁকি দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা চলমান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, দেশবন্ধু সুগার মিলস রিট পিটিশন (রিট পিটিশন নং-৬৬৩৪/০৭) করে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি হোম-কনজাম্পশন বন্ড লাইসেন্স পায়। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৯ সালের কাস্টম অ্যাক্টের ১০৪ ধারার আওতায় র-সুগার (অপরিশোধিত চিনি) আমদানি করে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-করাদি পরিশোধ না করে তার বন্ড গুদামে র-সুগার জমা রাখে।

লাইসেন্সের শর্ত ও ১৯৬৯ সালের কাস্টম অ্যাক্টের ৯৮ ধারা অনুযায়ী, ছয় মাস বন্ডিং মেয়াদের মধ্যে একই আইনের ১০৪ ও ৩০ (বি) অনুযায়ী এক্স বি/ই দাখিল করে শুল্ক-করাদি পরিশোধ করে বন্ড গুদাম থেকে কাঁচামাল খালাস করতে আইনগতভাবে দায়বদ্ধ। কিন্তু লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে কাঁচামাল বন্ড গুদাম থেকে অবৈধভাবে অপসারণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ১৩টি লামলা চলমান বলে জানিয়েছে এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১৩২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা শুল্ক-করাদি পরিশোধের জন্য ২০১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর কোম্পানিটিকে নোটিশ করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ না করায় ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি ২০২ ধারার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। পরে মামলার বকেয়া থেকে ৫ কোটি ও নিয়মিতভাবে খালাস করা র-সুগারের ওপর ২০ কোটি টাকা প্রদান করবে মর্মে একটি অঙ্গীকারনামা দাখিল করে প্রতিষ্ঠানটি। এ আবেদন আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ৭ মার্চ প্রতিষ্ঠানটি সচল রাখার স্বার্থে ২০২ ধারার নোটিশ সাময়িক প্রত্যাহার করা হয়।

এনবিআরের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, দেশবন্ধু সুগার মিলস সে সময় (২০১৯ সালের মার্চ) থেকে মাসিক ২৫ কোটি টাকা করে রাজস্ব দিয়ে আসছে। আইনত যেটুকু কাঁচামাল বন্ড গুদাম থেকে উৎপাদনের জন্য ব্যবহার হবে, ততটুকু রাজস্ব পরিশোধযোগ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত প্রদেয় প্রতি মাসে ২৫ কোটি টাকার বেশি হলেও তাদের দাখিল করা অঙ্গীকারনামাকেই রাজস্ব পরিশোধের আইনগত ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা করে চলেছে। ফলে প্রকৃত প্রদেয় রাজস্বের চেয়ে কম রাজস্ব জমা করায় বকেয়া পুঞ্জীভূত হচ্ছে ও মামলার উদ্ভব হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনত ও বৈধ দাবিনামাকে অপ্রাসঙ্গিক অজুহাতে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এনবিআরের নথি থেকে জানা গেছে, দেশের চিনি কলগুলোর ওপর স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি থাকার অজুহাতে আমদানি পর্যায়ে র-সুগারের ওপর মূসক অব্যাহতি চেয়ে দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৮ সালের ৩০ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আবেদন করে। পরে এ বিষয়ে আদালতে রিট পিটিশন (নং ৮৮৮৬/১৮) দায়ের করেন। আদালত তার আবেদন আইনানুগভাবে নিষ্পত্তির আদেশ দেন।

এরপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আমদানি পর্যায়ে কোনো প্রতিষ্ঠানকে চিনির ওপর মূসক অব্যাহতি দেয়া হয়নি মর্মে জানিয়ে তার আবেদন নাকচ করা হয়। আদালতের আদেশে মূসক আদায়ের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ থেকে মূসক পরিশোধ করা থেকে বিরত রয়েছে, যার পুঞ্জীভূত পরিমাণ ৪৫১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ থেকে সরকারি কোষাগারে দেয়া কাস্টম ডিউটি, আরডি ও ভ্যাট বাবদ ৮০৯ কোটি ২৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭৭ টাকা ফেরত চেয়ে কাস্টম বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে আবেদন করেছে।

আবেদনে উল্লেখ করা দাবি অনুযায়ী, তারা ২০০২ সালে সরকারের কাছ থেকে মেসার্স দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় করেছে এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অদ্যাবধি সরকারের কাছ থেকে আলোচ্য প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ মালিকানা বুঝে পায়নি। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) সদস্য হিসেবে মেসার্স দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডকে এখনও সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করে আসছে।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, লাইসেন্স পাওয়ার সময় দাখিল করা প্রতিষ্ঠানটির মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হোম কনজাম্পশন বন্ড লাইসেন্স নেয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবির আইনগত ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকারের সাকুল্য পাওনা ৯৪৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রথমে শুল্ক-করাদি পরিশোধ না করে কাঁচামাল বন্ড গুদাম থেকে অবৈধ অপসারণ এবং পরে বন্ড কমিশনারেট থেকে দাবিনামা ও বিচারাদেশ জারি করা হলে প্রতিষ্ঠানটি তার বিপরীতে মামলা করে বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব পরিশোধ আটকে রাখার অপকৌশল গ্রহণ করছে।

এনবিআর বলছে, প্রতিষ্ঠানটির সমজাতীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন- মেসার্স সিটি সুগার লিমিটেড, মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ও আব্দুল মোনেম সুগার মিলস লিমিটেড অপরিশোধিত চিনির ওপর প্রযোজ্য কাস্টম ডিউটি, আরডি, ভ্যাট, এটি ও এআইটি পরিশোধক রয়েছে। ভ্যাট পরিশোধের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে কোনো আপত্তি দেখা যায়নি। ফলে সমজাতীয় প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে রাজস্ব পরিশোধ করায় এ ক্ষেত্রে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড চিনির বাজারে অনৈতিক অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে।

জাতীয় রজস্ব বোর্ড থেকে তোলা এসব অভিযোগের বিষয়ে দেশবন্ধু সুগার মিলের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা এবং কোম্পানি সচিব লিয়াকত আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD