শরিয়া আইনে তালেবানের শাসন কেমন হবে?

নিউজ ডেস্ক
দক্ষিণ বাংলা বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১
শরিয়া আইনে তালেবানের শাসন কেমন হবে?

কয়েক সপ্তাহের তড়িৎ অভিযানে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আফগানিস্তানের সশস্ত্র ইসলামি গোষ্ঠী তালেবান বলেছে, তারা ইসলামের আইনি ব্যবস্থা শরিয়া আইনের কঠোর বিধি-বিধান অনুযায়ী দেশ শাসন করবেন। বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার কিছুদিনের মধ্যে এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশ দখলের পর রোববার কাবুলে প্রবেশ করে মঙ্গলবার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে এসে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ ‘ইসলামি আইনের কাঠামোর মধ্যে’ থেকে গণমাধ্যম এবং নারীর অধিকারের মতো বিষয়গুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে বলে জানান। তবে বাস্তবে শরিয়া আইনে দেশটির শাসন কেমন হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এখনও জানায়নি ইসলামি এই গোষ্ঠী।

সর্বশেষ তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন খুন এবং ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি প্রবর্তন অথবা সমর্থন করেছিল।

শরিয়া কী?

শরিয়া আইন হলো ইসলামের আইনি ব্যবস্থা। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের বিধান ও ইসলামি পণ্ডিতদের দেওয়া ফতোয়ার সমন্বয়ে শরিয়া আইন প্রবর্তিত হয়।

শরিয়া অর্থ কি?

শরিয়ার আক্ষরিক অর্থ পথ বা রাস্তা; যা অত্যন্ত স্বচ্ছ। শরিয়া আইন জীবন-যাপনের একটি বিধি হিসেবে কাজ করে; যা মুসলমানরা মেনে চলেন। এর মধ্যে নামাজ, রোজা এবং দরিদ্রদের দান করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। এর উদ্দেশ্যে হলো মুসলমানরা তাদের জীবনের প্রতিটি বিষয় সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী কীভাবে পরিচালনা করবেন; সেটি বুঝতে সহায়তা করা।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আপাদমস্তক ঢেকে জনসম্মুখে আসা নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করে তালেবান

শরিয়া আইনের চর্চা কেমন?

একজন মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে জানাতে পারে শরিয়া। উদাহরণ হিসেবে, কাজের পর কোনো সহকর্মী যদি তার একজন মুসলিম সহকর্মীকে পানশালা যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান; তাহলে ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুযায়ী সেখানে যেতে পারবেন কি-না তা জানতে একজন শরিয়া পণ্ডিতের কাছে যেতে পারেন তিনি।

দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন— পারিবারিক আইন, অর্থ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ইসলামের বিধি-নিষেধ জানার জন্য শরিয়ার স্মরণাপন্ন হতে পারেন মুসলিমরা।

শরিয়া আইনে অপরাধের সাজা কী?

শরিয়া আইনে অপরাধ সাধারণত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। হাদ অপরাধ এবং তাজির অপরাধ। হাদ অপরাধ হচ্ছে গুরুতর অপরাধ। যার শাস্তি পবিত্র কোরআনে নির্ধারিত আছে। আর তাজির অপরাধ হচ্ছে সেসব অপরাধ যার কথা কোরআনে বলা নেই এবং সাক্ষীর অভাবে এই অপরাধের সাজা বিচারকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

হাদ অপরাধের মধ্যে আছে চুরি। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীর হাত কেটে ফেলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া ব্যভিচারও এই শ্রেণির অপরাধের অন্তর্ভুক্ত; যার সাজা জনসম্মুখে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত করা।

জাতিসংঘ পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘এটি নির্যাতন বা অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি। এভাবে কাউকে সাজাপ্রদান স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।’

তবে হাদ অপরাধের জন্য বিশ্বের সব মুসলিম দেশ এ ধরনের সাজা কার্যকর বা মেনে চলে না। বিভিন্ন সময়ে চালানো জরিপে এ ধরনের অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি নিয়ে মুসলমানদের মনোভাবে বদল দেখা যায়।

গত মার্চে কাবুলে তালেবান এবং সরকারি প্রতিনিধিদের এক সম্মেলনে নারীরা বলেন, তালেবানের কোনও পরিবর্তন হয়নি

ধর্মান্তরের জন্য মুসলিমদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে?

ধর্ম অথবা বিশ্বাস ত্যাগ ইসলাম ধর্মে গুরুতর অপরাধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামি বেশিরভাগ পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, এটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।

কিন্তু অল্প কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ, বিশেষ করে যারা পশ্চিমা সমাজে বসবাস করেন, তারা যুক্তি দেন যে, ‘আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতায় শাস্তি সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। ধর্মত্যাগের কারণে ইসলাম ধর্ম হুমকিতে নেই। পবিত্র কোরআনেও ধর্ম নিয়ে জোর জবরদস্তি না করার কথা বলা হয়েছে।’

রায় কীভাবে তৈরি হয়?

যেকোনও আইনি ব্যবস্থার মতো শরিয়াও জটিল, এর চর্চা সম্পূর্ণরূপে মানসম্মত এবং বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞরা নির্দেশনা এবং আদেশ জারি করেন। যে নির্দেশনাকে আনুষ্ঠানিক আইনি রায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটিকে ফতোয়া বলে।

শরিয়া আইনে পাঁচটি ভিন্ন মাযহাব বা মতাদর্শ আছে। এর মধ্যে চারটি সুন্নি মতবাদ হলো হাম্বলী, মালিকি, শাফি ও হানাফি এবং অন্যটি শিয়া মতবাদ— শিয়া জাফারি।

তালেবানের শাসন কেমন হবে?

মাত্র কয়েকদিনের ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার একদিন পর মঙ্গলবার প্রথমবার সংবাদ সম্মেলন করেছে তালেবান। সেই সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শান্তির বার্তা দিয়ে তাদের শাসনে নারীরা ‘শরিয়া আইন অনুযায়ী’ স্বাধীনতা পাবেন বলে জানান।

তালেবানের এই মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা অভ্যন্তরীণ অথবা বহিরাগত কোনও শত্রু চাই না। নারীরা কাজের এবং পড়াশোনার অনুমতি পাবেন। তারা সমাজে অত্যন্ত সক্রিয় থাকবেন; তবে তা হবে ইসলামি কাঠামোর মধ্যে থেকে।’

‘বিশ বছর আগেও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। আজও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু অভিজ্ঞতা, পরিপক্কতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে বিশ বছর আগের তালেবানের সাথে আজকের তালেবানের বিশাল তফাৎ রয়েছে। আমরা এখন যেসব পদক্ষেপ নেব তার সাথে ওই সময়কার ফারাক আছে। আর এটা বিবর্তনের ফসল। তালেবান বলেছে, ইসলামের আইনি ব্যবস্থা শরিয়া আইনের কঠোর বিধি-বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হবে

তিনি বলেন, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে চাই যে, কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো ধরনের সমস্যা চাই না।

‘আমাদের ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুযায়ী কাজ করার অধিকার আছে। অন্যান্য দেশের যেমন ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ এবং নিয়ম-কানুন আছে… আফগানদের তেমন নিজস্ব মূল্যবোধ অনুযায়ী, ধর্মীয় বিধি-বিধানের আলোকে নিজস্ব নিয়ম-নীতি থাকার অধিকার আছে।’

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তালেবান। আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণের সেই সময় তালেবানরা যে শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ করেছিল তাতে নারী ও মেয়েদের বেশিরভাগই শিক্ষা ও চাকরি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। আপাদমস্তক ঢেকে জনসম্মুখে আসা নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় এবং পুরুষ সঙ্গী ছাড়া কোনো নারী ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। ব্যভিচার কিংবা খুনের দায়ে অভিযুক্তকে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তালেবানের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমবিষয়ক মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন, নারীরা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনার অনুমতি পাবেন। তালেবানের দখলে থাকা এলাকায় হাজার হাজার স্কুল এখনও চালু আছে। অপরাধের বিচারের দায়-দায়িত্ব আদালতের এখতিয়ারেই থাকবে, শরিয়া আইন অনুযায়ী আদালত পরিচালিত হবে।

জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, (আমরা) শরিয়া (ইসলাম আইন) আইন অনুযায়ী নারীদের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারাও আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে চাই, আফগানিস্তানে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না।

তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুযায়ী কাজ করার অধিকার আমাদের আছে

তবে কর্মক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের অধিকার পাবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেছে তালেবান। সংবাদ সম্মেলনে ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিকারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবিহুল্লাহ মুজাহিদ তা এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, তারা আমাদের ইসলামি আইন অনুযায়ী কাজ করার অধিকার পাবেন।

তালেবান ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত শহরে সাদা হিজাব ও কালো বোরকা পরে স্কুলে ফিরেছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা। বুধবার ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে মেয়েদের স্কুলে ফেরার এই খবর দিয়ে বলা হয়েছে, হেরাতের স্কুলের দরজা খুলে যাওয়ার পর ছাত্রীরা করিডোরে ও স্কুল চত্বরে আড্ডায় মেতে ওঠে। গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশটিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, ছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছে তারা সে বিষয়ে কিছুই জানে না।

তবে তালেবানের শাসনের রূপরেখা প্রকাশিত না হওয়ায় আফগানরা কী ধরনের ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তা এখনই বলা যাচ্ছে না।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD