২৫ শে মার্চ ১৯৭১ ইতিহাসের কালো অধ্যায় “অপারেশন সার্চলাইট”

ধনঞ্জয় দে
দক্ষিণ বাংলা বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১
২৫ শে মার্চ ১৯৭১ ইতিহাসের কালো অধ্যায় “অপারেশন সার্চলাইট”

আজ ভয়াল পঁচিশে মার্চ। ইতিহাসের এক কালো দিন। এইদিন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙ্গালীদের উপর শুরু করে এক নির্বিচার গনহত্যা। এটি ছিল একটি পুর্বপরিকল্পিত গনহত্যা। একটি জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করা ও তাদের মনোবলকে সম্পুর্ণভাবে ভেঙ্গে ফেলাই ছিল এই সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখানে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছিল। তারা চেয়েছিল শুধু এই মাটি অর্থাৎ এই ভুখন্ডটি। এদেশের মানুষকে তারা চায়নি। ২৩ বছরের শোষন বঞ্চনার থেকে মুক্তি পেতে বাঙ্গালী জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মানুষ জেগে উঠেছিল। ৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আওয়ামীলীগ কে ম্যান্ডেট দিয়েছিল ।পশ্চিমা সামরিক জান্তা কোনদিন চায়নি যে বাঙ্গালীরা ক্ষমতা পাক।

বাঙ্গালীরা পাকিস্তান শাসন করুক এটা তারা চায়নি। তাই তারা পুর্বপরিকল্পনা মত কৌশল করে নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর প্রতিশোধমূলক গনহত্যা শুরু করে। সে এমন এক বিভীষিকাময় রাত যার বর্ননা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আজো বাঙ্গালী শিউরে উঠে সেই কালোরাতের কথা মনে করে। ধারনা করা হয় সামরিক অভিযান শুরুর প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১০ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয় এবং সারারাত ধরে প্রায় একলক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়।পাকিস্তানী সৈন্যরা রাস্তায় নেমে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে।

ঢাকা ও আশেপাশের অঞ্চলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। সমগ্র বাংলাদেশকে তারা এক শ্মশানভুমিতে পরিনত করেছিল। জানা যায় রাত ১১ টার পরেই অভিযান শুরু হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট নামক এ অভিযানটি অনুমোদন দেওয়ার পরে পাকিস্তানি জেনারেলরা বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে গিয়ে পাঞ্জাবী সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করে।

তারা বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করে যাতে তারা পাল্টা প্রতিরোধ না করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন এবং করাচীতে তার বিমান অবতরনের পরেই জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়।

মূল পরিকল্পনা ছিল প্রথমে কারফিউ জারী করে টেলিফোন টেলিগ্রাফ বন্ধ করা,রেডিও টেলিভিশন বন্ধ করা,ঢাকা শহর কে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, অভিযান চলাকালে বঙ্গবন্ধু সহ ১৫ জন বড় আওয়ামীলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ,পিলখান ইপিআর হেডকোয়াটার,রাজারবাগ পুলিশলাইন দখল করে সবাই নিরস্ত্র করা ,যেসব স্থাপনায় বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাবে তা নষ্ট করে ফেলা এবং হিন্দু অধ্যষিত এলাকায় হামলা করে হিন্দুদের হত্যা করা।

প্রথমেই ২২ বালুচ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ট্যাঙ্ক কামান সহ ভারী অস্ত্র নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানায় আক্রমন চালায়। তারা ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতি শিক্ষক অধ্যাপক ডঃ জিসি দেব,ডঃ মনিরুজ্জামান,অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সহ অনেক শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানীরা হামলা চালালে এখানেই বাঙ্গালী পুলিশরা তাদের প্রথম প্রতিরোধ করে এবং প্রায় সারা রাত যুদ্ধ করে। এখানে প্রায় ৩০০ বাঙ্গালী পুলিশ শহীদ হয়। এরপর পিলখানার ইপিআর হেডকোয়াটারে হামলা চালিয়ে সব বাঙ্গালী জওয়ানদের হত্যা করা হয়।

পুরোনো ঢাকায় প্রায় ৭০০ মানুষকে রাতেই হত্যা করা হয়। এই অভিযানের আভাস পেয়ে বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে ১২ টায় তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। এই ঘোষনা তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে ইপিআরের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। তিনি বলেন “শেষ সৈন্যটিকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সবাইকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে”।

রাত একটা নাগাদ মেজর বেলাল ও কর্নেল জেড আই খানের নেতৃত্বে একটি কমান্ডোদল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। সারা রাতে ঢাকা এক ধ্বংসস্তপে পরিনত হয় ।চারদিকে শুধু পোড়া ঘরবাড়ি আর লাশের পাহাড় যা শকুন আর কুকুরের খাবারে পরিনত হয়েছিল।

এত বড় আঘাত হানার পরেও বীর বাঙ্গালীরা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বর্তমানে এদিনটি জাতীয় দিবস হিসেবে বিশেষ মর্যাদায় পালন করা হয়।


আরো নিউজ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD